জানেন কি; মৃত্যুর পর মানুষকে কতদিন কবরে থাকতে হবে?
গল্প: "কবরে অপেক্ষার অন্তিম সত্য"
সালাম গ্রামের মসজিদ থেকে মাগরিবের আজান শোনা যাচ্ছে। আজান শেষ হতে না হতেই সালেহা বেগম ঘরের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। কয়েকদিন আগে তার স্বামী, আব্দুল হামিদ সাহেব, মারা গিয়েছেন। মৃত্যুর পর থেকে সালেহার মন খারাপ, কারণ স্বামীর চলে যাওয়ার বেদনায় তার মন ভারাক্রান্ত। একাকীত্ব এবং অনিশ্চয়তার মাঝে তিনি একদিন আল্লাহর রহমতের আশায় ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছেন।
মৃত্যু এবং কবরের জগত
মানুষের মৃত্যু মানেই পৃথিবীর জীবন শেষ হয়ে এক অন্য জগতে প্রবেশ করা। কুরআন ও হাদিস অনুযায়ী, মৃত্যু হলো দুনিয়া থেকে বারজাখে প্রবেশের প্রথম ধাপ, যেখানে কবরই প্রথম মঞ্জিল। এই সময়টাতে মৃত আত্মা কবরের আজাব বা নেয়ামত অনুভব করে। নবী কারীম (সাঃ) বলেছেন, “কবর হলো আখিরাতের প্রথম মঞ্জিল। যদি কেউ এতে রক্ষা পায়, তবে তার জন্য পরবর্তী ধাপগুলো সহজ হয়ে যাবে। আর যদি কবরেই ব্যর্থ হয়, তবে পরবর্তী ধাপগুলো আরও কঠিন হবে।” (তিরমিজি)
সালেহা মনে মনে ভাবছিলেন, “কবরের এই দীর্ঘ সময় কাটাতে তার স্বামী কেমন আছেন?” এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে তিনি মসজিদের ইমাম সাহেবের সাথে দেখা করলেন।
ইমামের পরামর্শ ও উপদেশ
ইমাম সাহেব সালেহার কথা শুনে বলেন, “কবরের জীবন কতদিনের, তা নির্দিষ্টভাবে বলা কঠিন। কেয়ামত আসার আগ পর্যন্ত মৃতরা বারজাখের জগতে অপেক্ষা করে। এই সময়টাতে মৃতরা কবরের মুসিবত এবং নেয়ামত উভয়ই পেতে পারে। যারা সৎকর্ম করেছেন, তারা এই সময়টা আল্লাহর নেয়ামত পেয়ে কাটাবেন। আর যারা আল্লাহর অবাধ্য ছিলেন, তাদের জন্য কবর হবে এক শাস্তির স্থান।”
সালেহা জিজ্ঞাসা করলেন, “ইমাম সাহেব, কবরের শাস্তি বা নেয়ামত সম্পর্কে আরও কিছু বলুন।” ইমাম সাহেব বললেন, “কবরের জীবন কেমন হবে, তা নির্ভর করে আমাদের দুনিয়ার আমলের ওপর। হাদিসে এসেছে, মুমিন ব্যক্তির কবরকে জান্নাতের একটি বাগানের মতো করে দেওয়া হবে, আর কাফেরদের কবর হবে জাহান্নামের গর্তের মতো।” (মুসলিম) কবরের প্রথম রাত
ইমাম সাহেব আরও বললেন, “মৃত্যুর পর প্রথম রাতই সবচেয়ে কঠিন। মুনকার ও নাকির নামে দুজন ফেরেশতা এসে প্রশ্ন করবে— ‘তোমার প্রভু কে? তোমার দ্বীন কী? এবং তোমার নবী কে?’ একজন মুমিন সঠিক উত্তর দিয়ে আল্লাহর নেয়ামতে আবদ্ধ হবেন, আর যারা অবাধ্য ছিল, তারা শাস্তি পেতে থাকবে।”
সালেহা গভীর চিন্তায় পড়ে গেলেন। তিনি ভাবলেন, “আমার স্বামী কি এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পেরেছেন?” তিনি জানতেন যে, এই উত্তর নির্ভর করে মানুষের ইমান ও সৎ আমলের ওপর।
#### কবরের সময় কতদিন?
কবরের সময়কাল নিয়ে সালেহার মনে আরও প্রশ্ন জাগল। তিনি জানতে চাইলেন, “ইমাম সাহেব, এই কবরের সময় কতদিন চলবে?” ইমাম উত্তর দিলেন, “কবরের সময় কেয়ামত পর্যন্ত। কেয়ামতের দিন আল্লাহ সব মৃতকে জীবিত করে তুলবেন এবং বিচার শুরু হবে। কবরের অপেক্ষা এক এক জনের জন্য এক এক রকম। কেউ হয়তো কয়েক হাজার বছর অপেক্ষা করবে, আবার কেউ কয়েক মুহূর্ত। কেয়ামত যতদিন না আসে, মৃতদের কবরের জীবন চলতেই থাকবে।”
ইমাম সাহেব আরও বলেন, “কেয়ামত থেকে কেবল আল্লাহর বান্দারাই মুক্তি পাবে, যারা এই পৃথিবীতে সৎ কাজ করেছে। তারা আর কবরের এই অপেক্ষার সময় অনুভব করবে না। কিন্তু যাদের আমল খারাপ, তাদের জন্য এই অপেক্ষা হবে অত্যন্ত কষ্টকর।”
সালেহার উপলব্ধি
ইমাম সাহেবের কথা শুনে সালেহার মনে কিছুটা স্বস্তি এলো। তিনি জানলেন, কবরের এই সময়কাল আসলে অনন্ত অপেক্ষার অংশ, যেখানে মূল বিচার হবে কেয়ামতের দিন। তিনি অনুভব করলেন, তার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সৎকর্ম করা এবং আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা যেন তিনি ও তার পরিবার কবরের এই কঠিন সময় থেকে মুক্তি পান।
তিনি ঠিক করলেন, প্রতিদিন তার স্বামীর জন্য দোয়া করবেন, কুরআন তেলাওয়াত করবেন এবং দান করবেন। কবরের জীবন যেমনই হোক না কেন, সালেহা জানেন, আল্লাহ সব সময় তার বান্দার জন্য রহমতের দরজা খুলে রাখেন।
গল্পের শিক্ষা
এই গল্প আমাদের মনে করিয়ে দেয়, মৃত্যু হলো দুনিয়া থেকে বারজাখে প্রবেশের এক মাত্রা, যেখানে কবরের জীবন শুরু হয়। এই সময়কাল আল্লাহর ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল এবং মানুষের আমল এর ওপরই নির্ভর করে এই জীবনের সহজ বা কঠিন হওয়া। সৎকর্ম, ইমান এবং আল্লাহর প্রতি আনুগত্যই পারে আমাদের কবরের জীবনের কষ্ট দূর করতে এবং আমাদের আল্লাহর নিকটবর্তী করতে।
“তোমরা নিজেরা নিজেদের প্রস্তুত করো, কারণ কেয়ামত নিশ্চিত এবং কবরের অপেক্ষা দীর্ঘ। আল্লাহ যেন আমাদের সবাইকে ক্ষমা করেন এবং কবরের আজাব থেকে রক্ষা করেন।”
এই গল্পটি আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, দুনিয়ার জীবন ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু কবরের জীবন ও আখিরাতের জীবন অনন্ত। আল্লাহর পথে চলাই আমাদের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত।
Comments
Post a Comment